স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র কাকে বলে? ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রটি আলোচনা কর

পোস্টটি শেয়ার করুন
5/5 - (1 vote)

দ্বাদশ শ্রেণির (Class-12) ভূগোলের (Geography) ক্ষয়চক্র অধ্যায়ের (Erosion Chapter) গুরুত্বপূর্ণ একটি টপিক ক্ষয়চক্র। এবং ক্ষয়চক্র অধ্যায় থেকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র এবং ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র (Davis Cycle of Erosion) টি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হল। টপিকটি কলেজ স্তরের জিওমরফোলজি (Geomorphology) থেকে CBCS Syllabus-অনুসারে তৈরি।

ক্ষয়চক্র কাকে বলে ও শ্রেনিবিভাগ করঃ-

ভূগাঠনিক প্রক্রিয়ায় উত্থিত কোনো ভূমিভাগ পর্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থা থেকে ক্রমানুসারে কয়েকটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে শেষ অবস্থায়(ক্ষয়ের শেষ সীমায়) পৌঁছায়, এবং এইভাবে ভূমিরুপের পনুরুত্থান ও পুনঃক্ষয়সাধন চক্রাকারে আবর্তিত হওয়াকে ক্ষয়চক্র বলে। অর্থাৎ কোনো ভূমিভাগের সৃষ্টি ও বিনাশ চক্রের আকারে আবর্তিত হলে সেই প্রক্রিয়াকে ক্ষয়চক্র বলে। এই ক্ষয়চক্রের ধারণাটি প্রথম দেন ‘হাটন’(১৭৮৫)।

ক্ষয়চক্রের শ্রেনিবিভাগ-

ক্ষয়চক্রের মাধ্যমে ভূমিরূপের বিবর্তন বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির (নদী, বায়ু, হিমবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ, ভৌমজল ইত্যাদি) মাধ্যমে ঘটে। এই শক্তিগুলির সাপেক্ষে অঞ্চলভেদে ক্ষয়চক্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১. নদী ক্ষয়চক্র বা স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রঃ- আর্দ্র অঞ্চলে নদীর ক্ষয়চক্র লক্ষ করা যায়।

Join us on Telegram

২. হিমবাহ ক্ষয়চক্রঃ- উচ্চ অক্ষাংশ বা পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়চক্র লক্ষ করা যায়।

৩. বায়ু ক্ষয়চক্রঃ- উষ্ণ মরু অঞ্চল বা উপকুলিয় অঞ্চলে বায়ুর ক্ষয়চক্র লক্ষ করা যায়।

৪. সামুদ্রিক ক্ষয়চক্রঃ- সমুদ্র উপকূলবর্তি অঞ্চলে দেখা যায়।

৫. কার্স্ট অঞ্চলের ক্ষয়চক্রঃ- চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে ভৌমজলে ক্রিয়ায় এই ক্ষয়চক্র লক্ষ করা যায়।

স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র কাকে বলে?

স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রঃ- পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ৭০% অঞ্চলের ভূমির ভাস্কর্য গঠনে নদীর ক্ষয়কার্যের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। এমনকি মরুভূমি, হিমবাহ অঞ্চলেও নদীর ভূমিকা লক্ষ করা যায়।তাই নদীর দ্বারা ক্ষয়চক্রকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলা হয়। স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ধারণা প্রথম প্রদান করেন উইলিয়াম মরিস ডেভিস ১৮৯৯ খ্রিঃ।

ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রটি আলোচনা কর।

ডেভিসের প্রাথমিক ধারণাঃ-

১৮৬৯ সালে চার্লস ডারউইন এর ‘The Origin of specis’ থেকে জীবজগতের বিবর্তনের যে সূত্র পাওয়া যায়, তার দ্বারা প্রাভাবিত হয়ে ডেভিস ভূমিরূপ বিবর্তনের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রটি উপস্থাপিত করেন। ডেভিসের এই মতবাদটি ‘ঢাল-হ্রাস মতবাদ বা Slope Decline Theory’ নামে পরিচিত। ডেভিসের মতে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র হল- “Geographical cycle is that period of time in which an uplifted lamd area through weathering and erosion is coverted into a plain surface without any characteristics”.

ডেভিসের ক্ষয়চক্রের নিয়ন্ত্রকঃ-

ডেভিসের মতে কোনো অঞ্চলের ভূমিরূপের বিবর্তন নির্ভর করে সেই অঞ্চলের শিলার গঠণ (Structure), ক্ষয়কার্যের প্রক্রিয়া (Process) এবং সময় বা পর্যায় (Time)। এই তিনটি বিষয়কে একত্রে “ডেভিসের ত্রয়ী” বলে। অর্থাৎ ডেভিসের মতে- ‘ভূমিরূপ হল গঠণ, প্রক্রিয়া, ও পর্যায়ের সামগ্রিক ফল” (Landscape is a function of structure, Process, and stage). নিম্নে এই তিনটি বিষয়কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

১. গঠনঃ- গঠন বলতে ডেভিস বুঝিয়েছেন, সেই অঞ্চলের শিলার কাঠিন্য, নতি, ভাঁজ, চ্যুতি, প্রবেশ্যতা প্রভৃতি।

২. প্রক্রিয়াঃ- প্রক্রিয়া বলতে ভূমিরূপ গঠনে প্রভাব বিস্তারকারী আবহবিকার, ক্ষয়ীভবন, নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি।

৩. সময় বা পর্যায়ঃ- সময় বলতে, বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলি ওই অঞ্চলে কত সময় ধরে ক্রিয়াশীল, সেটিকে বুঝিয়েছেন। ডেভিস সময় বা পর্যায়কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- যৌবন পর্যায়, পরিণত পর্যায় ও বার্ধক্য পর্যায়।

চিত্রঃ ডেভিসের ক্ষয়চক্র মডেল
চিত্রঃ ডেভিসের ক্ষয়চক্র মডেল

ডেভিসের ক্ষয়চক্রের প্রাথমিক শর্তঃ-

ডেভিস তাঁর ক্ষয়চক্র মডেলটি ব্যাখ্যার জন্য কতকগুলি শর্ত ও প্রাথমিক অনুমাণের সাহায্য নিয়েছেন। যথা-

১. ভূমিরূপটি একটি ভূ-তাত্ত্বিক একক হিসাবে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে দ্রুত উত্থিত হবে। এবং উলম্ব ভাবে উত্থান হবে।

২. উত্থানের সময় কোনো ক্ষয়কাজ হবেনা। উত্থানকার্য শেষ হওয়ার পর ক্ষয়কাজ শুরু হবে।

৩. অঞ্চলটির শিলার গঠন সরল এবং সব জায়গায় সমান হবে।

৪. ক্ষয়কার্য চলাকালীন ভূমিরূপ স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে।

৫. অঞ্চলটিকে আর্দ্র জলবায়ুর অন্তর্গত হতে হবে, যাতে করে নদী সৃষ্টি হতে পারে ও নদী দ্বারা ক্ষয়কার্য সম্পন্ন হতে পারে।

৬. ভূমিরূপের প্রাথমিক ঢাল হবে সমুদ্রমুখী এবং ক্ষয়ের শেষ সীমা হবে সমুদ্রতল।

৭. ক্ষয়ের শেষ সীমা পর্যন্ত নদী নিম্নক্ষয় করতে সক্ষম।

৮. নদী ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রকৃয়া যথা- আবহবিকার, ক্ষয়ীভবন ইত্যাদি শক্তিগুলি ও অংশগ্রহন করবে।

৯. ক্ষয়কার্যের শেষ পর্যায়ে ভূমিরূপটি একটি সমতল্ভূমিতে পরিনত হবে।

১০. ক্ষয়কার্য আংশিক সম্পন্ন হওয়ার পর, পুণরায় ভূমিরূপের উত্থান ঘটবে, এবং আবার নতুন করে ক্ষয়কার্য শুরু হবে।

ডেভিসের ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ঃ-

ডেভিস তাঁর ক্ষয়চক্রটি একটি চিত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন, যেটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এই তিনটি পর্যায়কে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

চিত্রঃ ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়
চিত্রঃ ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়

(অ) যৌবন পর্যায়ঃ-

অঞ্চলটিতে ভূমিভাগের উৎপত্তি সমাপ্ত হওয়ার পর, ভূমির ঢাল বরাবর একটি অনুগামি নদী গঠিত হয় ও অনুগামি নদীর সাথে অনেক উপনদী মিলিত হয়ে ক্ষয়কার্য্র অগ্রগতি হয়। এই পর্যায়ে যে যে বৈশিষ্ট ও ভূমিরূপগুলি লক্ষ করা যায় সেগুলি হল-

১. ভূমির উচ্চতা ও ঢাল বেশি হওয়ায় নদীগুলি নিম্নক্ষয় করতে থাকে এবং সংকির্ণ ও গভীর নদীখাত সৃষ্টি করে।

২. এই পর্যায়ে প্রশস্থ জলবিভাজিকা সৃষ্টি হয়।

৩. নদীর গতিপথে জলপ্রপাত, ক্যাটার‍্যাক্ট ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।

৪. এই পর্যায়ে অবঘর্ষ প্রক্রিয়াতে নদীগর্ভে মন্থকুপ সৃষ্টি হয়।

৫. এই পর্যায়ে নদীর আপেক্ষিক উচ্চতা সর্বাধিক হয়।

৬. নিম্নক্ষয়ের কারণে ভূমির বন্ধুরতা বৃদ্ধি পায়।

৭. যৌবন অবস্থার শেষে নদীর সংখ্যা হ্রাস পায় এবং বিভিন্ন ভূমিরুপের বিলোপ ঘটে।

৮. অন্যান্য পর্যায়ের তুলোনায় যৌবন পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল কম।

(আ) পরিণত পর্যায়ঃ-

যৌবন অবস্থার শেষে ভূমিভাগটি থেকে যখন তার ভূ-উত্থানের সময়কার সব চিহ্ন মুছে যায়, তখন শুরু হয় পরিণত পর্যায়। এই পর্যায়ে যে যে বৈশিষ্ট ও ভূমিরূপগুলি লক্ষ করা যায় সেগুলি হল-

১. এই পর্যায়ে পরবর্তী নদী সৃষ্টি হয়।

২. নিম্নক্ষয় কমে যায় ও পার্শ্বক্ষয় বৃদ্ধি পায়। ফলে জলবিভাজিকাগুলি সংকির্ণ আকার ধারণ করে।

৩. এই পর্যায়ে ভূমির বন্ধুরতা সর্বাধিক হয়।

৪. এই পর্যায়ে প্লাবনভূমির ওপর নদীবাঁক,বালুচর, ও শোল সৃষ্টি হয়।

৫. এই পর্যায়ে ভূমির ঢালের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পর্যায়িত ঢালের সৃষ্টি হয়।

৬. পরিনত পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল যৌবন অপেক্ষা অধিক কিন্তু বার্ধকের তুলনায় কম।

(ই) বার্ধক্য পর্যায়ঃ-

ক্ষয়চক্রের শেষ অবস্থা হল বার্ধক্য পর্যায়। এই সময় নিম্নক্ষয় একেবাড়ে বন্ধ হয়ে যায় এবং পার্শ্বক্ষয় চলতে থাকে। এই পর্যায়ে যে যে বৈশিষ্ট ও ভূমিরূপগুলি লক্ষ করা যায় সেগুলি হল-

১. এই পর্যায়ে নদীর সংখ্যা পরিনত অবস্থার থেকে কম কিন্তু যৌবন অবস্থার থেকে বেশি।

২. জলবিভাজিকার বিলুপ্তি ঘটে।

৩. এই পর্যায়ে বিভিন্ন ভূমিরূপ গড়ে ওঠে যথা- অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ, বিনুনি আকৃতি জলনির্গম প্রনালী,স্বাভাবিক বাঁধ, বালিয়াড়ি প্রভৃতি।

৪. এই সময় ভূমিভাগটি একটি সমতল ভুমিতে পরিনত হয়, যাকে ডেভিস পেনিপ্লেন বা সমপ্রায় ভূমি নাম দিয়েছেন।

৫. এই পেনিপ্লেনের মাঝে কোথাও কোথাও ক্ষয় প্রতিরোধী কঠিন শিলাগঠিত টিলা বা অবশিষ্ট পাহাড় অবস্থান করে। এদের ডেভিস মোনাডনক বলেছেন।

৬. বার্ধক্য পর্যায় ততদিন পর্যন্ত চলে যতদিন পর্যন্ত না ফলে ভূমির পুনরুত্থান ঘটে।

ডেভিসের ক্ষয়চক্রর সমালোচনাঃ-

ডেভিসের ক্ষয়চক্র ধারণাটি পেঙ্ক, হ্যাক,কিং প্রমুখ বিজ্ঞানীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। যেমন-

১. ডেভিসের ধারণা অনুযায়ী ভূমির উত্থান ঘটবে হঠাৎ ও দ্রুতহারে। কিন্তু বাস্তবে দেখাগেছে ভূমি উত্থিত হয় অত্যন্ত ধীর গতিতে।

২. ডেভিসের ধারণা অনুযায়ী যৌবন পর্যায় শুরুর আগেই উত্থান পর্ব শেষ হবে। কিন্তু পেঙ্ক সমালোচনা করে বলেছেন যে, উত্থান বার্ধক্য অবস্থা পর্যন্ত চলতে থাকবে।

৩. ডেভিসের ধারণা অনুযায়ী দীর্ঘকাল ভূমি সুস্থির থাকবে। কিন্তু বাস্তবে এটি সম্ভব নয়।

৪. ডেভিস সময়কে বেশি গুরুপ্ত দিয়েছেন, কিন্তু পেঙ্ক এটির বিরোধিতা করেছেন।

ডেভিসের ক্ষয়চক্রের তত্ত্বের গুরুত্বঃ-

ডেভিসের ক্ষয়চক্রটি সমালোচিত হলেও এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গুরুপ্ত রয়েছে। যথা-

১. ডেভিস প্রথম ক্ষয়চক্র ধারণাটিকে বিজ্ঞান ভিত্তিক ভাবে ব্যাখ্যা করেন।

২. ডেভিস তাঁর ক্ষয়চক্রটিকে একটি মডেলের মাধ্যমে প্রকাশ করেন, ফলে এটি বুঝতে সুবিধা হয়।

৩. তাঁর এই তত্ত্ব থেকে ক্ষয়সীমা, পর্যায়িত নদী, পার্শ্বচিত্রের সামঞ্জস্য প্রভৃতি ভূমিরূপ বিশ্লেষণের বিষয়গুলির সঠিক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

Students Care

স্টুডেন্টস কেয়ারে সকলকে স্বাগতম! বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার সমস্ত খবরা-খবরের একটি অনলাইন পোর্টাল "স্টুডেন্ট কেয়ার"। পশ্চিমবঙ্গের সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সমস্ত চাকুরী প্রার্থীদের জন্য, এছাড়াও সকল জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গদের সুবিধার্থে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: স্টুডেন্টস কেয়ার কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত !!